শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সংক্ষিপ্ত জীবন কথা
উনবিংশ শতকের বাংলা তথা ভারতের এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। এই শতকে বাংলাদেশে একদিকে যেমন এসেছেন ভক্ত, জ্ঞানী, যোগী তেমনি অপরদিকে এসেছেন দেশপ্রেমিক, বৈজ্ঞানিক, কবি ও সাহিত্যিক।
আজ থেকে দুইশ সত্তর বছর আগে ১৭৩০ খৃঃ পশ্চিম বাংলার ২৪-পরগনণা জেলার বারাসাত সাবডিভিসনের অন্তর্গত চৌরাশী চাকলা নামক একটি গ্রামে বাবা লোকনাথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তাঁর পিতা রামনারায়ণ ঘোষাল, ভক্তি পরায়ণ নিষ্ঠাবান সৎ ব্রাহ্মণ রূপে সমাজে সবার প্রিয় ছিলেন এবং মাতা শ্রীমতী কমলা দেবী ছিলেন পবিত্রতা এবং মমতার এক অপরূপ মাতৃমূর্ত্তি।
উনবিংশ শতকের যোগীশ্রেষ্ট মহাপুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। পিতা রামনারায়ণ চন্দ্রের ইচ্ছা তাঁর চার পুত্রের মধ্যে এক পুত্র সন্ন্যাসধর্ম্ম গ্রহন করে এবং ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে। কারণ শাস্ত্রে কথিত আছে যদি বংশে কেউ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে তবে সেই বংশের সদ্গতি এবং মুক্তি হয়। শিশু লোকনাথ জন্মগ্রহণের পূর্বে মাতা কমলাদেবীর ইচ্ছানুসারেই পিতা রামনারায়ন তিন পুত্রের কাহাকেও সন্ন্যাস দিবার বাসনা কার্যে রূপায়িত করিতে পারেন নাই। কারণ মাতা কমলাদেবী কোন সন্তানকেই নিজের কোল হইতে বিদায় দিয়া গৃহত্যাগী করিয়া সন্ন্যাসী করিয়া দিতে সম্মত হন নাই। শিশু দিন দিন বাড়িতে লাগিল। শুভদিনে অন্নপ্রাশন সম্পন্ন হইল এবং নামকরন হইল লোকনাথ। ভক্তজ্ঞানী পিতার পুত্রের নাম করনেই দূরদর্শিতার পরিচয়। যে শিশু ভবিষ্যতে পৃথিবীর মানুষের মুক্তির পথ দেখাইবে, যাহার দয়ায়,করুণায় মানুষ জীবনে অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করিতে সমর্থ হইবে তিনি তো সকলের নাথ তাই লোকনাথ ছারা আর উপযুক্ত নাম কই? ক্রমে শিশু হাটিতে শিখিল। খেলিতে হইবে সঙ্গী কোথায়? সঙ্গী জুটিল এক বালিকা। কিন্তু খেলিবে কি? উপযুক্ত বালকের উপযুক্ত খেলা পূজা-পূজা, ধ্যান-ধ্যান খেলা শুরু হইল। বালীকা খেলার ছলে ফুল সংগ্রহ করে।আর খেলার ছলে ধ্যানে নিমগ্ন হয় ক্রমে তাঁহার চোখ হয় পূলকহীন, দেহ হইয়া ওঠে ঋজু, শাস প্রশ্বাস-স্তব্ধ-বালিকা ভয় পায়। পিতা রামনারায়ণ একদিন এই দৃশ্য দেখিয়া মনের বাসনার পূর্ণতার ইঙ্গিত পাইয়া আকুল হইয়া উঠিলেন। ছুটিলেন গ্রামের পন্ডিতশ্রেষ্ট সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞ মহাজ্ঞানী মহাজন ভগবান গাঙ্গুলীর নিকট উপযুক্ত গুরুর উপযুক্ত শিষ্যকে তুলিয়া দিবার ব্যবস্থা করিতে। ভগবান গাঙ্গুলী জ্ঞানের পূজারী, বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে সবকিছু জানবার প্রবণতা, তিনি জ্ঞানযোগী। তিনি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী না হলেও অনাসক্ত মনোভাব সম্পন্ন, সংসারে থেকেও নেই। কালক্রমে লোকনাথের অপর এক খেলার সঙ্গী জুটিয়া গেল ঐ গ্রামেরই ছেলে, তাঁহারই সমবয়সী বেণীমাধব। শুভদিন উপস্থিত, বালক লোকনাথের শুভ উপনয়ন, সন্ন্যাস গ্রহণের শুভলগ্ন। বালক বেণীমাধব বন্ধুর সন্ন্যাস গ্রহণের সংবাদে পূলকিত হয়ে উঠল। অভিভাবকদের জানাল নিজ মনের অভিলাষের কথা। সেও গ্রহণ করবে সন্ন্যাস। পিতা মাতা আত্বীয় স্বজন সকলে বেণীমাধবকে এই দুরূহ সংকল্প হইতে চ্যুত করিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু সক্ষম হইলেন না।
উপনয়নের শুভদিন উপস্থিত। আত্বীয় ও আনাত্বীয়ের ভিড়ে মুখরিত উৎসব গৃহ। মাতা কমলা শত আনন্দ ও উৎসাহের মধ্যেও মনে হয় বুকটা যেন একেবারে খালি। এবার লোকনাথের অভিষেক। সন্ন্যাস নেবার শুভক্ষণে যাত্রা শুরু। সকলের আগে চললেন লোকনাথ, মাঝখানে বাল্য সহৃদ সঙ্গী বেণীমাধব, পিছনে শুরু ভগবান গাঙ্গুলী। পেছনে পেছনে চললেন মাতা কমলাদেবী, পিতা রামনারায়ণ ও অগণিত গ্রামবাসী এই সন্ন্যাসী বালকদের গ্রামের সীমান্তে বিদায় দিতে। দুই কিশোর শিষ্যসহ গুরু ভগবান গাঙ্গুলী গৌরীপুর, মধ্যমগ্রাম, পাঁতিপুকুর, কলিকাতা, গোবিন্দপুর, সুতানটী অতিক্রম করে উপস্থিত হলেন কালীঘাটে। তারা উপস্থিত হলেন হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান কালীঘাট! যাত্রীরা ক্লান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগের পর আশ্রয় নিলেন যাত্রীশালায় ঘরে বিশ্রামের প্রয়োজনের তাগিদে।
তীর্থক্ষেত্রে সর্বস্থানের সর্ব্বশ্রেণীর মানুষের মিলন। বালক লোকনাথ সাধু সন্তানদের দেখে মজা অনুভব করেন। সাধু সন্ন্যাসীরা এই বালকের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে গুরু ভগবানের নিকট নালিশ করলেনÑভগবান শিষ্যদের বোঝালেন জীবনে মানুষ যে রকম ব্যবহার করে তাকেও ঠিক সেইরূপ ব্যবহারই পেতে হয়।
অন্যকে দু:খ দিলে, সুখ দিলে বিনিময়ে সুখ পাওয়া যাবে আর তাছাড়া ভবিষ্যতে লোকনাথকেও এই সাধুদের মত লেংটি পড়ে জীবন কাটাতে হবে।
লোকনাথের মনে বিস্ময় জাগে। গুরু তার কর্ত্তব্য করে শিষ্যের মনের সমস্যার, সমাধান করে। ভগবান গাঙ্গুলী বোঝালেন সন্ন্যাস জীবনের চিত্র। কিন্তু জ্ঞানী বালকের জিজ্ঞাসার শেষ নাই। বালকের প্রত্যেক যুক্তিই বয়স্কজনোচিত।
গুরু বুঝলেন এই বালকের ভবিষ্যৎ সফলতার কথা। আবার পথ ধরে চলছেন অভিযাত্রী। পথের বাধা বিঘœ অতিক্রম করে নদীনালা পার হয়ে অমূল্য বস্তুর সন্ধানে। তুচ্ছ করে মানুষে পরম কাম্য কাম, কামিনী, কাঞ্চন, সুখ ভোগ, প্রতিষ্ঠা।আহারে বিহারে স্বাচ্ছন্দ্যকে করেছেন প্রত্যাহার। মায়ামমতা করে এসেছেন পদদলিত। এই ভাবে দীর্ঘ বার বৎসর অতিক্রম হওয়ার পর গুরু ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্যদ্বয় সহ আবার জন্মভুমিতে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। এই সময়ে হঠাৎ যুবক লোকনাথের সহিত ঐ গ্রামের এক ব্রাহ্মণ বাল্য বিধবার প্রণয় হয়। দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়। লোকনাথের মন ক্রমশঃ বিষময় হইতে শুরু করে কিন্তু ভগবান গাঙ্গুলী আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার কথা বলেন। ক্রমশঃ তাঁহার মন হইতে নারী জাতির প্রতি সহজাত আকর্ষণ লুপ্ত হয় আর তখন ঐ প্রণয়িনীর আকর্ষণ অনুভব করে না। লোকনাথ গুরুর এই আচরণে শব্দ হইয়া চেলা কাঠ দিয়া গুরুকে মারিতে উদ্যত হয়। ভগবান গাঙ্গুলী এই দিনটির আশায় বসিয়াছিলেন। তিনি শিষ্যকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন,“এবার তোর পাপ মুক্ত হইয়াছে-এবার তুই চল”।
গুরু শিষ্যদ্বয়কে নিয়ে আসেন লোকালয়ে হইতে দুরে হিমালয়ের কোলে। নিজে ভিন্ন করে স্বয়ং রান্না করেন মাতার মতন, সেবা করেন শিষ্যদ্বয়ের। হঠাৎ একদিন লোকনাথ গুরু দেবকে বিদ্যাশিক্ষা দানের জন্য অনুরোধ করেন। উত্তরে ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্যদ্বয়কে জানান যে তাঁহার যত জ্ঞান সঞ্চিত আছে তাহা আস্তে আস্তে কালক্রমে তাহার শিষ্যদের মধ্যে সংক্রামিত হইবে। গুরু শিষ্যদ্বয়কে কঠোর ব্রহ্মচর্য্য পালন করাইবার উদ্দেশ্যে পর্য্যায়ক্রমে নক্তব্রত, একান্তরা, ত্রিরাত্র পকাহ ও ক্রমে নবরাত্র ও দ্বাবদাহ ও সব্বোপরি মাসহ ব্রত পালন করাইলেন।
নক্তব্রতে ব্রহ্মচারীগণকে দিবাভাগে উপবাসী থাকিয়া রাত্রে যৎসামান্য আহার করিতে হয় এবং মাসাহ ব্রতে এক মাসকাল উপবাসী থাকিয়া পরে আহার করিতে হয়। এই ব্রত অনুষ্ঠান সমূহ পালনের কালে গুরু ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্যদিগকে কোনরূপে অঙ্গ সঞ্চালন করিতে দিতেন না কঠোর মাসাহ ব্রত লোকনাথ দুইবার পালন করেন কিন্তু বেণীমাধব এই ব্রত পালনে অক্ষম হন। সমস্ত ব্রতানুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর লোকনাথ নিজের উরুর উপর পায়েস রন্ধন করিয়া গুরুদেবকে ভোগ দিয়া ব্রহ্মচর্য্যের পরীক্ষা দেন। এর পর ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্যদ্বয়কে হটযোগ শিক্ষা দেন, চন্দ্র ও সূর্য্যরে মিলনই হইল হটযোগ।
তখন লোকনাথের সমাধি- এমন ছিল যে দেহেতে জল জমে বরফ হয়ে আবার কখন গলিয়া যাইত তাহা টেরও পাইত না। এই অবস্থায় একদিন লোকনাথ গুরুর চরণে পতিত হইয়া কাঁদিয়া আকুল হইলেন যে গুরুর দৌলতে শিষ্য যে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছে গুরুর এখনও তাহা হয় নাই।
এর দীর্ঘদিন পরে বাবা লোকনাথ ডেঙ্গু কর্ম্মকারের সহিত বারদী গ্রামে আসিয়া আশ্রয় স্থাপন করেন। ক্রমে ক্রমে ডেঙ্গু কর্ম্মকারের অবস্থা ফিরিয়া যায়। প্রথম প্রথম এই যোগীকে সকলে উপহাস করিত। কিন্তু ঘটনা পরষ্পরায় এই মহান যোগীর অলৌকিক কার্য্যবলী লক্ষিত হওয়ার পর সারা গ্রামে তাঁহার গুণমূগ্ধ শিষ্য ও ভক্তের সংখ্যা স্ফীত হইয়া উঠিল।
১৬০ বৎসর বয়সে এই মহাজ্ঞানী তপস্বী যোগী দীনজনের পক্ষে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বারদী গ্রামে দেহরক্ষা করেন।
লোকনাথ আশীর্বাদ প্রাপ্তিই হোক আমাদের একমাত্র পাথেয়।
আলেখ্য শুধু রহিয়াছে হেথা জাগায় মনে তোমারী বারতা গায় যেন সদা তব গুণাগাথা কলুষ রসনা আমারি \
অলক্ষ্যে আলেখ্য তব রূপ ভাতি জাগুক অন্তরে জ্বলন্ত মূরতি পলকবিহীন আঁখির পাতি বিানিশি যেন নেহারি \
আদেশিছে যেন ও আখি যুগল কর্তব্যের পথে চল মূঢ় চল পাইবে পারাণে অমৃত অমল হৃদয়েরি তম পরিহরি \
আমার মানস চঞ্চল দুর্বল ধাবিত সদা কুপথে কেবল থাকে যেন ভক্তি তোমাতে অচল জীবন সঁপেছি চরণে তোমারি \
প্রভু, দাসানুদাস আমি হে তোমার ভুলি যেন নাহি ও চরণ আর দেখেছি অন্তরে করিয়া বিচার তুমি গুরর গুরু আমারি \