
শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার পাঁচালী
এসো এসো পাপী তাপী আর ভক্তগণ। লোকনাথ বাবার কথা করহ শ্রবণ। যে নাম সরিলে সর্বজীবনের নিস্তার। মহাযোগী লোকনাথ নামটি তাঁর। আশুতোষ সম তিনি অতি দয়াবান। স্মরণেতে পরাগতি করেন প্রদান। ডাকলে তাঁহারে সর্বপাপ দূরে যায়। অজ্ঞানতা নাহি থাকে তাঁর কৃপায়। যারাবদ্ধ হয়ে জীবন রয়েছে সংসারে। কিসে পাবে মুক্তি তারা খোঁজে বারে বারে। লোকনাথ কর্মফল দাতা। জীবের কল্যাণীকামী শুভফল দাতা। এ সংসারে কারাগারে করতে নিস্তার। পরম দয়াল বাবা নেন সর্বভার। সবে এসো ধরি তাঁর যুগল চঁরণ। সফল হউক তাই মানব জীবন। আবির্ভাব চব্বিশ পরগণা জেলা পশ্চিম বঙ্গেতে। চাকলা নামে গ্রামে মহকুমা বারাসতে। শ্রীরামনারায়াণ ঘোষাল নামেতে। শান্তিতে করেন বাস গ্রাম চাকলাতে। শ্রীকমলা দেবী হন তাঁর গৃহীণী। দেব-দ্বিজে ভক্তি সদা সতী সীমন্তণী। স্ত্রী ডেকে বলে রাম নারায়ণ। এক পুত্র তুমি মোরে করবে অর্পণ। সে পুত্র গৃহ ছাড়ি সন্ন্যাসী হবে। তার ফলে বংশ মোর উদ্ধার পাবে। অতঃপর তিন পুত্র তাঁর জন্মিল। কিন্তু পুত্রে দিতে মাতা রাজী না হল। ভুমিষ্ট হল যবে চতুর্থ সন্তান। সন্ন্যাসীর তরে তারে করল প্রদান। অপূর্ব সুন্দর শিশু দেখে নয়নে। মাতা পিতা আনন্দিত হলেন মনে। নহেক সামান্য শিশু বলে সকলেতে। নানারূপ সুলক্ষণ রয়েছে অঙ্গেতে। চাকলার পার্শ্ববর্তী গ্রাম কচুয়াতে। ভগবান গাঙ্গুলী থাকে নিজ ভবনেতে। মহান পÐিত তিনি অতি জ্ঞানবান। ব্রহ্মতেজে তেজী তিনি অতি নিষ্ঠাবান। রামনারায়নের সাথে পরিচয় ছিল। সংবাদ পেয়ে তিনি দেখতে আসল। সর্ব সুলক্ষণযুক্ত দেখে শিশুরে। অতিশয় আনন্দিত হলেন অন্তরে। ভগবান পাঁজি দেখি নির্ধারণ করল। লোকনাথ নাম তাঁর তিনিই রাখল। রামনারায়ণ মনে যাহা ভেবেছিল। ভগবান গাঙ্গুলীরে সকলি কহিল। অতঃপর বললেন রামনারায়ণ। আমার পুত্রের ভার করুণ গ্রহণ। বললেন ভগবান উত্তম এ কথা। এক সত্য মনে তুমি রাখো সর্বদা। উপনয়নের কার্য যবে শেষ হবে। পুত্র তব গৃহ ছাড়িমোর সঙ্গে যাবে। সম্মত হলেন তাহে রামনারায়ণ। ভগবান গাঙ্গুলী হলেন আনন্দিত মন। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ অবশেষে একদিন ইচ্ছাপূর্ণ হল। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করি ধ্যানভঙ্গ হল। চক্ষু মেলি শিষ্যদ্বয় দেখেন চাহিয়ে। সম্মুখেতে গুরুদেব আছে দাঁড়ায়ে। গুরুর চরণে শিষ্য প্রণাম করল। গুরুদেব শিষ্যদের বুকে তুলে নিল। গুরু বলে ওরে শিষ্য কি বলব আর। আজও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়নি আমার। শুনি তা লোকনাথ দুঃখিত হল। গুরুর চরণে ধরি কাঁদতে লাগল। ব্রহ্মজ্ঞান লাভিবারে আদেশ করিয়া। আপনি রহিলে প্রভু কাঙাল হয়ে। গুরু বলে সিদ্ধিলাভ হলো হিমালয়ে। এবার চলো মোরা যাই লোকালয়ে। যোগ- সাধনা ক্রমে ক্রমে গ্রাম ছাড়ি তাঁরা তিনজন। দীর্ঘ পথ হাঁটি তাঁরা করেন গমন। শহর নগর গ্রাম পার হয়ে যায়। নদ-নদী বনকৃত ছাড়ি অগ্রসর হয়। মহাতীর্থ পীঠস্থান কালীঘাটে এসে। ভগবান গাঙ্গুলী সেথা থামলেন শেষে। ঘন জঙ্গলেতে ভরা ছিল পীঠস্থান। চালা ঘরে ছিল মাতৃমূতি অধিষ্ঠান। খরস্রোতা আদিগঙ্গা বেগে বয়ে যায়। চারিদিকে বন সেথা নাহি লোকালয়। শক্তি সাধানার দেখি উপযুক্ত স্থান। গাঙ্গুলী করেন সেথা কুটির নির্মাণ। এক বৃক্ষতলে গুরু আসন করিয়া। বসালেন শিষ্যদ্বয়ে যতন করিয়া। বিভিন্ন সাধনা গুরু শেখান যতনে। শিষ্যদ্বয় গুরু আজ্ঞা পেলে সযতনে। কালীঘাটে কিছুদিন সাধনা করিয়ে। প্রস্থান করেন গুরু শিষ্যদের নিয়ে। গঙ্গা পার হয়ে গুরু লয়ে শিষ্য দ্বয়। গভীর জঙ্গলে আসি উপস্থিত হয়। জঙ্গলের মাঝে এক মনোরম স্থানে। শিষ্যদের লয়ে গুরু আসল সে খানে। লতা-পাতা দিয়ে এক কুটির রচিয়ে। অবস্থান করে গুরু শিষ্যদের নিয়ে। একদিন গুরুদেব শিষ্যদের কন। এবার নক্তব্রত করহ পালন। শুনি শিষ্যদ্বয় কহে আবাক হয়ে। নক্তব্রত কিবা গুরু দিল বুঝিয়ে। নক্ত অর্থে রাত্রি ব্রত অর্থে উপবাস। আহার সংযম করলে অভ্যাস। গুরু হয় নক্তব্রত গুরুর আদেশে রাত্রিতে আহার দিনে থাকে উপবাসে। ভিক্ষা করি গুরুদেব তিল দুগ্ধ আনে। সিদ্ধ করি শিষ্যদের খাওয়ান যতনে। শিষ্যদ্বয় থাকে সাধনায় রত। শিষ্যদের সেবা গুরু করেন নিয়ত। নক্তব্রত একদিনসমাপ্ত হল। একান্তরাব্রত শুরু করতে বলল। একদিন একরাত্রি পূর্ণ অনশন। পরদিন একবেলা আহার গ্রহণ। একান্তরা ব্রত পূর্ণ হল যখন। করতে ত্রিরাত্রি বৃত গুরুদেব কন। তিনদিন তিনরাত্রি পূর্ণ অনশন। তারপর একদিন আহার গ্রহণ। ত্রিরাতে ব্রত শেষ যেদিন হল। পঞ্চাহের ব্রত শুরু করতে বলল। পাঁচদিন করে তাঁরা পূর্ণ অনশন। একদিন একবেলা আহার গ্রহণ। পঞ্চাহের ব্রত শেষ যেদিন হল। নবরাত্র ব্রত গুরু আদেশ করল। নয়দিন উপবাস থাকে শিষ্যদ্বয়। একদিন খায় শুধু গুরু যা দেয়। এইরূপে নবরাত্র ব্রত করি শেষ। দ্বাদশাহ ব্রত করে গুরুর আদেশে। উপবাস করি তাঁরা থাকে বারোদিন। আহার করেন পরে মাত্র একদিন। পঞ্চাহের ব্রত করে গুরু আদেশে। এক পক্ষ পর একদিন খায় শেষে। এই ব্রত শেষে মাসাহের ব্রত নেয়। একমাস পরে একদিন মাত্র খায়। এরূপে ব্রত আর সাধনা করতে। চল্লিশ বছর কাটে দেখতে দেখতে। গুরুর বয়স হল শতেক বছর। শিষ্যদের বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বছর। গুরুবাক্য শিষ্যদ্বয় করেন পালন। গুরুর নির্দেশ মতো করেন সাধনা। অতঃপর লোকনাথ গুরুর আদেশে। দ্বিতীয় মাসাহ ব্রত করে অবশেষে। একমাস পরে মাত্র একদিন খায়। পূর্বজন্ম স্মৃতি তাহে লোকনাথ পায়। জাতিস্বর হন তিনি গুরুর কৃপাতে। শিষ্যদের লয়ে গুরু থাকে আনন্দেতে। তারপর গুরুদেব শিষ্যদের লয়ে। সাধানার জন্য তিনি আসেন হিমালয়ে। পর্বত বাহিরে গুরু লয়ে শিষ্যদ্বয়। ক্রমে ক্রমে উঠলেন পর্বত চ‚ড়ায়। শিষ্যদ্বয় দেখলেন হয়ে বিস্মিত। গাছপালা কিছু নেই বরফ আবৃত। হিমের প্রবাহ শুধু চারদিকে বয়। নাহি কল-কোলাহল গম্ভীরতময়। সেখানে দেখলেন গুরু ভগবান। রয়েছে সাধনার উপযুক্ত স্থান। মনোরম গুহ্য মধ্যে গুরু প্রবেশিয়া। আসন করে দেন যতন করিয়া। সে আসনে শিষ্যদ্বয়ে গুরু বসাল। তারপর তাঁদের আদেশ করল। এখানে তপস্যা কর বসি দু’জনায়। যতদিন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ নাহি হয়। যাহা কিছু শিখায়েছি আমি একদিন। যা কিছু করেছ ব্রত আচরণ এতদিন। তপস্যার সেসব সাহায্য করবে। নিস্তরঙ্গ ব্রহ্মজ্ঞান ইথে লাভ হবে। ইন্দ্রিয় রবে বশে বিক্ষিপ্ত হবে না। ক্ষুধাতৃষ্ণা তোমাদের কিছু থাকবে না। ভয় নেই আমি আছি তোমাদের পাশে। জেগে রব তোমাদের সিদ্ধিলাভ আশে। আমার লেগে বৎস নাহি কোনও ভয়। সুস্থ দেহে রব আমি ঈশ্বর কৃপায়। গুরুকে প্রাণাম করি শিষ্য দু’জনে। তপস্যা করতে তাঁরা বসল দু’জনে। গুরু আর শিষ্যদ্বয় মিলি তিনজন। একাগ্র মনেতে তাঁরা করেন সাধনা। দিবা-রাত্রি, শীত-গ্রীস্ম কিছু নাই মনে। সমাধি যোগেতে স্থির রহে শিষ্যগণে। দিবা রাত্র পক্ষ করি কাটে কত মাস। একে একে কেটে গেল বছর পঞ্চাশ। দাউদকান্দি গমন সঙ্গি ছাড়ি লোকনাথ একাকী যে যায়। অবশেষে আসলেন ত্রিপুরা জেলায়। দাউদকান্দি আসি বসে বৃক্ষের তলায়। সম্মুখের পথ দিয়ে কত লোক যায়। কেহ বা পাগল ভাবি নাহি দেখে ফিড়ে। কেহ ফলমূল দেয় সেবা তরে। একদিন এক ব্যাক্তি আসল তথায়। ডেঙ্গু কর্মকার নাম পরিচয় দেয়। অপরাধী ছিল ডেঙ্গু বিচার অধীনে। প্রাণদন্ড হবে তার সকলেই জানে। লোকনাথ শ্রীচরণে লইল আশ্রয়। কাতরে বলল বাবা বাঁচাও আমায়। কৃপাময় লোকনাথ বলেন তারে। মুক্তি পাবি অবশ্যই বলে দিনু তোরে। দিন আদালতে রায় বাহিরিল। নির্দোষ বলে ডেঙ্গু খালাস পেল। লোকনাথ শ্রীচরণে ধরি ডেঙ্গু কয়। কৃপা করি দাও বাবা চরণে আশ্রয়। বারদী গ্রামেতে বাবা চলো মোর সাথে। তথাকারপাপী তাপী উদ্বার করতে। চিন্তা করি লোকনাথ সম্মত হল। ডেঙ্গুর সাথে বাবা বারদীতে গেল। আশ্রম স্থাপন বারদীর জমিদার নাগ মহাশয়। শুনে বাবার কথা আনন্দিত হয়। জমিদার প্রণমিয়া বাবার চরণে। কৃপা করে চলো বাবা আমার ভবনে। লোকনাথ বলে আর গৃহে না থাকব। ভ‚মি কিছু দাও মোরে তথায় রহিব। বাবা নিজে এক স্থান পছন্দ করল। আশ্রম মন্দির সেথা নির্মাণ হল। তারপর একদিন অতি শুভক্ষণে। আশ্রম প্রতিষ্ঠা হৈল মহা ধূমধামে। এক গোয়ালিনী ছিল আশ্রমের পাশে। বাবার লাগিয়ে নিত্য দুধ লয়ে আসে। অনাথা সে গোয়ালিনী বলল বাবারে। আশ্রমে থাকব বাবা আজ্ঞা দাও মোরে। শুনি তা লোকনাথ আনন্দিত মন। বলেন থাক মা তুমি মায়ের মতন। পূর্বজন্মে গোয়ালিনী ছিল তাঁর মা। যোগবলে লোকনাথ জানে সে বারতা। আশ্রমের মাতা বলি পরিচিত হয়। সর্বকার্য ভার নিজ হাতে তুলে লয়। অনাথা কৈবর্ত নারী একজন ছিল। বাবার আশ্রমে আসি আশ্রয় লইল। আশ্রমের কন্যারূপে হয় পরিচিত। আশ্রম মাতার কার্য সাহায্য করত। এরূপে প্রসিদ্ধ হয় বাবার আশ্রম। দিনে দিনে বৃদ্ধি পায় ভক্ত সমাগন। একদা বিজয় কৃষ্ণ লয়ে ভক্তগণ। বারদীর আশ্রমেতে করে আগমন। বিজয়কৃষ্ণের নাম সকলেই জানে। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক সকলেই মানে। নৌকা চড়ি বিজয়কৃষ্ণ আসতে লাগল। যোগবলে লোকনাথ জানতে পারল। লোকনাথ ডেকে বলে সব ভক্তগনে। এসেছে বিজয় কৃষ্ণ আনো সযতনে। অতি শুদ্ধ আত্মা তার সকলে জানবে। বহুদিন পরে তার সঙ্গে দেখা হবে। আসিয়ে বিজয়কৃষ্ণ দেখি লোকনাথে। আনন্দ সাগরে যেন লাগল ভাসতে। দেখল বিজয়কৃষ্ণ হয় বিস্মিত। লোকনাথে ঘেরি দেব-দেবী বিরাজিত। লোকনাথ দেহ হ’তে জ্যোতি বাহিরিল। বিজয়কৃষ্ণের দেহে প্রবেশিল। বিজয়কৃষ্ণের বাবা বুকে তুলে লন। চতুর্দিকে দাঁড়াইয়ে দেখে ভক্তগণ। পাকা বেল লয়ে বাবা উচ্ছিষ্ট করে। প্রসাদ দিলেন তাঁরে স্বহস্তে ধরে। এরূপে উভয়ের হল মিলন। আনন্দিত হয় দেখে যত ভক্তগণ। বারদী আশ্রম নাম প্রসিদ্ধ হল। তীর্থস্থান রূপে তাহা গণ্য যে হল। যেই জন লয় লোকনাথের স্মরণ। অনায়াসে হয় তার অভীষ্ট পূরণ। বাবা লোকনাথ বলে যেইজন ডাকে। আপদে বিপদে বাবা রক্ষা করে তাকে। দেশ-দেশান্তর হতে ভক্ত আসে যায়। যা চায় তা পায় বাবার কৃপায়। কালীঘাটে মানত করে একজন। মনোমত ফললাভ করল যখন। কালীঘাটে পূজা তারে দিতে যেতে হবে। পথের খরচ কিন্তু কোথাথেকে পাবে। অবশেষে বলে আসি আশ্রম মাতারে। সে কথা গিয়ে মাতা বলল বাবারে। শুনে সে কথা বাবা মৃদু হেসে কয়। আমাকেই দিলে কালীঘাটে পূজা হয়। আমারে যা দেবে তাহা পাবেন মা কালী। নিয়ে এসো মোর কাছে পূজার যে ডালি। শুনি তা সে ব্যক্তি আনন্দিত হলো। ¯œান করি পূজা লয়ে আশ্রমেতে এলো। বাবার মন্দির মাঝে প্রবেশ করল। মহাকালী মূর্তি সেবা দেখতে পেল। প্রণাম করে মাতা বসল আসনে। লোকনাথ বসে আছে সহাস্য বদনে। ভাওয়ালের মহারাজ আসল আশ্রমে। প্রণাম করল আসি বাবার চরণে। ফটো তুলে নিতে তার ইচ্ছাহয় মনে। অনুমতি চায় রাজা বাবার চরণে। অনুমতি দাও বাবা লোকনাথ বলে। গোপনে রাখব বাবা তব ফটো তুলে। প্রয়োজন হলে তাহা প্রকাশ করব। এক্ষণে তাহা আমি গোপনে রাখব। আপনার অপ্রকটে এই চরাচরে। পূজিত হবে ছবি প্রতি ঘরে ঘরে। কাতরতা দেখি বাবা দিল অনুমতি। ফটো তুলে নিল রাজা আনন্দিত অতি। আসিছে অন্তিম দিন বাবা চিন্তান্বিত। ভক্ত লাগি কৃপা তার হল বর্ধিত। সময় সমাপ্ত হয়ে আসতেছে হায়। ভক্ত তবু বাবা কৃপা বিতরয়। মহাপ্রয়াণের দিন করি নির্বাচন। ভক্তগণ সঙ্গে করে নানা আলোচন। মহাপ্রয়াণের কিছু পেয়ে আভাস। মনে মনে ভক্তগণ পেয়ে মহা ত্রাস। সে সময় জৈষ্ঠ মাস গরমের দিন। আঠারো তারিক সেটা শনিবার দিন। পরিব্রাজক সাধু আসে বারদীতে। লোকনাথ শিষ্য রামকুমার নামেতে। বারদী নিবাসী এক ভক্ত যে বাবার। প্রবীণ বয়স্ক চন্দ্র ভট্টাচার্য নাম তাঁর বাবার চরণে আসি প্রণাম করলো। সাধনার কথা বাবা তারে বুঝাল। এইরূপে লয়ে বাবা শিষ্য ভক্তগণ। শাস্ত্র কথা লয়ে করে নানা আলোচন। | দেশ ভ্রমণ হিমালয় হতে নামি ভ্রমিতে ভ্রমিতে। আসলেন তাঁরা শেষে কাবুল দেশেতে। সবে মুসলমান দেখি লোকনাথ ভাবল। এখানে থেকে তবে কিবা লাভ হবে। অভিপ্রায় বুঝি গুরু লোকনাথ কন। মুসলমানের ধর্ম জানব এখন। কি পার্থক্য আছে বেদ আর কোরাণে। জেনে লইব তা অতি যতনেতে। কবি মোল্লা সাদী নামে মুসলমান ছিল। তাঁর গৃহে শিষ্যসহ আশ্রয় লইল। কোরাণ ও শাস্ত্র লয়ে আলোচনা করে। ইসলাম ধর্মের তত্ত¡ জানল অচিরে। কিছুদিন কাটিয়ে তাঁরা কাবুলেতে। যাত্রা করলেন কাশীধামের পথেতে। গুরু ভগবান চিন্তা করেন অন্তরে। আর কিবা প্রয়োজন থেকে সংসারে। নর দেহ পুনরায় ধরতে হবে। লোকনাথ শিষ্য হ’তে আবার আসবে। যত কিছু কাজ ছিল সমাপ্ত তাঁর। এই দেহ ধারণ করি কাজ কিবা আর। কাশীধামে দেহত্যাগ বাসনা করিয়া। গুরু ভগবান আসে শিষ্যদের নিয়ে। মহাতীর্ত কাশীধাম অতি পূর্ণস্থান। বিশ্বনাথ অন্নপূর্ণা রহে অধিষ্ঠান। মণিকাঞ্চণ ঘাটে দেখেন এসে। শ্রীতৈলঙ্গস্বামী সেথা আছেন বসে। শিবতুল্য মহাযোগী মহাজ্ঞানী ইনি। হিতলাল নামে হেতা পরিচিত যিনি। গুরু ভগবান তাঁর নিকটেতে গিয়ে। শিষ্যদ্বয়ে তাঁর হাতে দিলেন তুলিয়ে। বললেন শিষ্য দুটি করুন গ্রহণ। সময় হয়েছে মোর বাবার গমন। তারপর গঙ্গানীয় ¯œান সমাপিয়ে। বসলেন ভগবান আসেন করিয়ে। হেথা শিষ্যদ্বয় ছিল গুরুর আশ্রমে। বিলম্ব দেখে তাঁরা ভাবে মনে মনে। গঙ্গায় গেছেন গুরু গেনের আশায়। কিবা হেতু ফিরিবারে এত দেরী। অধৈর্য হয়ে শেষে শিষ্য দু’জনে। গঙ্গাতীরে দেখে গুরু বসে একস্থানে। আছেন বসে নিস্পন্দ নিথর। নিমীলিত চক্ষু দুটি স্থির কলেবর। বার বার শিষ্যদ্বয় ডাকতে লাগল। কিন্তু হায় গুরুদেব সাড়া নাহি দিল। অমঙ্গল ভয়ে দেহ স্পর্শ করতে। প্রাণহীন দেহ ঢলি পড়ল মাটিতে। শিষ্য দুটি রাখে গাঙ্গুলী ভগবান। মহাপ্রস্থানের পথে করল পয়ান। হাহাকার করি উঠে শিষ্য দু’জনে। এসে ত্রৈলঙ্গস্বামী সান্তনা প্রদানে। অতঃপর পুত্রাধিক দু’টি শিষ্য তাঁর। শেষকৃত্য করে যা শাস্ত্রের আচার। ত্রৈলঙ্গস্বামীর সনে ফিরে আসল। তাঁরই আশ্রমে বাস করতে লাগল। বাল্যজীবন ক্রমেক্রমে বাড়ে শিশু যেন শশধর। পিতা-মাতা দেখি তারে আনন্দ অন্তর। প্রতিবেশী পুত্র বেণীমাধব নামেতে। তার মনে লোকনাথ খেলে আনন্দেতে। অত্যন্ত চঞ্চল এই বালক দু’জন। প্রতিবেশীগণে সদা করে জ্বালাতন। বেণীমাধব লোকনাথ একই শুভদিনে। উপনীত হলেন শাস্ত্রের বিধান। ভগবান গাঙ্গুলী তাহে আচার্য হল। এক সঙ্গে উভয়ের উপনয়ন দিল। আত্মীয়-স্বজন এলো আমন্ত্রিত সব। পাড়া প্রতিবেশী আসে মহা কলরব। জ্যোতির্ময় দেহধারী ভগবান গাঙ্গুলী। উপবীত দু’জনার কাঁধে দেন তুলি। গাঙ্গুলী বলেন ওহে রামনারায়ণ। তব পুত্র লয়ে আমি করব গমন। পূর্ব প্রতিশ্রতি মত হয়েছে সময়। লয়ে যাব তব পুত্রে দাও হে বিদায়। রামনারায়ণ শুনি আনন্দিত চিত্তে। তুলে দিল পুত্র তাঁর গাঙ্গুলীর হাতে। বেণীমাধব বলে আমি যাব সঙ্গেতে। যেথা লয়ে যাবে গুরু যাব সেখানাতে। ভগবান গাঙ্গুলী হয়ে আনন্দিত মন। ব্রহ্মচারীদ্বয় লয়ে করেন গমন। মুন্ডিত মস্তক আর দন্ড লয়ে হাতে। বেণীমাধব লোকনাথ বাহিরিল পথে। তিন জনে পথ বাহি যান ধীরে ধীরে। প্রতিবেশীগণ সবে ভাসে অশ্রুনীরে। পুনরায় দেশ ভ্রমণ এরূপে কাশীধামে কিছুদিন গেল। দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা মনেতে হল। লোকনাথ সঙ্গে লয়ে বেণীমাধবেরে। সেকথা জানালেন ত্রৈলঙ্গস্বামীরে। আনন্দে ত্রৈলঙ্গস্বামী দেন অনুমতি। যেথা ইচ্ছা দু’জনার কর অগ্রগতী। রেখো মনে, যখনই প্রয়োজন হবে। তখনি আমার দেখা অবশ্য পাবে। এরূপে দু’জন পেয়ে আশ্বাস। পদযাত্রা করি যায় মিটাতে আশ। দন্ড কমন্ডলু লয়ে হাঁটতে হাঁটতে। আসি উপনীত হন আফগানিস্থানেতে। পারস্য ভ্রমণ করি আরবে আসল। মক্কা মদিনায় যাবে বাসনা করল। হজরত মুহম্মদ জন্মিয়ে মক্কাতে। ইসালাম ধর্ম প্রবর্তন করেন জগতে। প্রচার করিয়ে শেষে গিয়ে মদিনাতে। দেহরক্ষা করি যান মহাপ্রয়াণেতে। যত জ্ঞাণী মুসলমান ছিল মক্কায়। সন্ন্যাসী দু’জনে তাঁরা সম্ভ্রম জানায়। মুসলমান গৃহে তাঁরা আশ্রয় লভিল। জাতি না মেনে সেবা অধিকার দিল। মক্কা মদিনায় তারা করে ভ্রমণ। মক্কেশ্বর তীর্থপথে করল গমন। মরুভ‚মি পার হয়ে সেই তীর্থস্থান। সহজে পাবে না কেউ যেতে সেই স্থান। কিছুদুর গিয়ে তারা পথিক দেখল। ফকির আছেন সেথা পথিক কহিল। শুনি লোকনাথ বেণীমাধবের সনে। আসলেন রয়েছেন ফকির যেখানে। অতি বৃদ্ধ সে ফকির অলৌকিক রূপ। দেখি লোকনাথ হন নীরব নিশ্চুপ। বুঝলেন ব্রহ্মজ্ঞানী বৃন্তে স্থিত মন। ফকির সামান্য নয় ইনিই ব্রাহ্মণ। চোখে চোখে কথা হয় ফকিরের সনে। সেকথা বুঝবে না কোন সাধারণে। আব্দুল গফুর নাম গ্রহণ করে। মরুমাঝে রয়েছেন ফকির হয়ে। ছড়িয়ে আরব দেশে তাঁরা দুজন। তুরস্ক ইতালি গ্রীস করেন ভ্রমণ। সুইজারল্যান্ড দেশ ভ্রমণ করল। তারপর দু’জনে ফ্রান্সেতে আসল। এরূপে ইউরোপ করি পর্যটন। স্বদেশে এসে তাঁরা দিল দর্শন। লোকনাথ সঙ্গে লয়ে বেণীমাধরে। এবার করল তাঁরা গমন উত্তরে। হরিদ্বারে গঙ্গা¯œœান করি দু’জনে। হিমালয়ে উঠে যান আনন্দিত মনে। হিমালয়ে তীর্থ সব করে দর্শন। অবশেষে বদ্রীনাথ করেন দর্শন। সুমেরু পর্বতে তবে যেতে বাসনা। সে কারণে দু’জনে করল সাধনা। সুমেরু যাত্রা তিন বর্ষ সাধনাতে তাদের কাটল। সুমেরুতে যেতে তারা প্রস্তুত হল। সহসা ত্রৈলঙ্গস্বামী আসেন সেখানে। তিনিও যেতে চান সুমেরু ভ্রমণে। এইরূপে তিনজন একত্র হয়ে। সুমেরুর পথে যান নির্ভর হয়ে। ক্রমশ তুষারে দেহ স্বেতবর্ণ হয়। মানুষ কি অন্য প্রাণী বুঝা নাহি যায়। ক্ষুধা তৃষ্ণা নিদ্রা ক্লান্তি দিয়ে বিসর্জন। সুমেরুর পথে চলে যোগী তিনজন। অবশেষে দীর্ঘপথ করি অতিক্রম। আসলেন মেরুদেশে করি বহু শ্রম। বিচিত্র সেস্থান সেথা নাহি দিবালোক। চির অস্তমিত সূর্য নাহি সূর্যলোক। তুষারে সর্বত্র ঢাকা গাঢ় অন্ধকার। কিছু দেখা নাহি যায় বিচিত্র ব্যাপার। ক্রমে তাঁরা দৃষ্টিমুক্তি যেন ফিরে পেল। ধীরে ধীরে অন্ধকারে দেখতে পেল। দর্শনীয় যা ছিল দেখি অবশেষে। ফিরতে উদ্যত তাঁরা ফিরলেন শেষে। তারপর তিনজন সমতলে আসে। ত্রৈলঙ্গ বলেন চলো যাব চীনদেশে। নদ-নদী পর্বত জঙ্গল অতিক্রম। আসলেন চীনদেশে নানা দেশ ভ্রমি। শত্রু ভাবি চীনরাজ কারারুদ্ধ করে। কিছুদিন তাঁদের কাটে কারাগারে। অবশেষে কারামুক্ত হয় তিন জন। আসলেন ফিরে চীন দেশ ভ্রমণ করে। বলেন ত্রৈলঙ্গস্বামী লোকনাথে ডাকি লোহিতকর কিছু কার্য কর দেখি। ব্রক্ষজ্ঞ পুরুষ তুমি ফিরে যাও দেশে। পযটর্ন ত্যাজ্ব থাক ভক্ত পরিবেশে। বেণীমাধবের লয়ে করহ গমন। আমি যাই পূর্বাচলে করতে ভ্রমণ। চন্দ্রনাথ পর্বত আগমন ত্রৈলঙ্গস্বামী আজ্ঞা পেয়ে তখন। আসামের পথে তাঁরা চলে দু’জন। নির্জনে থাকার লাগি দুই যোগীবরে। উঠলেন চন্দ্রনাথ পর্বত শিখরে। সেথা এক বনমধ্যে দেখি বৃক্ষতল। করলেন সেখানেতে নিবাসের স্থল। সেখানে কিছুদিন নির্বিঘেœ কাটল। দু’জনে সেই বৃক্ষতলেতে রহিল। অকস্মাৎ একদিন বিপদ ঘটল। বনমধ্যে দাবানল জ্বলিয়ে উঠল। লোকনাথ দেখি বেণীমাধবের কয়। বনমধ্যে এক যোগী রয়েছে নিশ্চয়। যাক হেথা, যাই আমি তার উদ্ধারে। নতুবা সে দাবাবলে দগ্ধ হতে পারে। দেখলেন লোকনাথ বনমধ্যে গিয়ে। জটাজুটধারী যোগী রয়েছে বসিয়ে। লোকনাথ তাঁর দেহ কোলে তুলে নিল। দবানলে হতে তাঁরে বাইরে আনল। এই যোগীর নাম আজ সবার বিদিত। গোস্বামী বিজয় কৃষ্ণ নামে তিনি খ্যাত। অদ্বৈত আচার্য বংশে লভে জনম। করেছিলেন তিনি ব্রহ্ম দরশন। চন্দ্রনাথ অবস্থান করে যে শেষ। লোকনাথ চললেন দূর বঙ্গদেশ। গেলেন না বেণীমাধব লোকনাথ সাথে। মনে স্থির করলেন যাব কামাখ্যতে। বললেন লোকনাথ হে সাথী আমার। দরকার হলে পুন আসিও আবার। তারপর দু’জন কোলাকুলি করি। লোকনাথ যান চলি গুরুদেবে স্মরি। বারদীতে অগমন। বারদীতে আসি বাবা ডেঙ্গুর ভবনে। রহিলেন কিছু দিন আনন্দিত মনে। নগ্নদেহ শিরে জটা দেখি সবে কয়। নিশ্চয় পাগল এটা কভু সাধু নয়। নাহি শোনে কোনও কথা ডেঙ্গু কর্মকার। সাধ্যমত সেবা করে লোকনাথ বাবার। ভাগ্য ফিরে যায় তার বাবার কৃপায়। দেখে সকল লোক মানিল বিস্ময়। পাগল ও নীচ জাতি সবে ভাবে মনে। লোকনাথ এসব কথা শুনেও না শোনে। একদিন পথমাঝে চারটি ব্রাহ্মণ। উপবীত লয়ে করে তর্ক অকারণে। গ্রন্থি দিয়ে উপবীতে পাকায়েছে জট। তারই কারণে তর্ক করছে বিকট। লোকনাথ তাদের নিকটেতে গেলে। দুরহ’ এখান হতে তারা বলল। লোকনাথ বলে তর্ক কর অকারণ। কোন গোত্র তোমাদের বল তো এখন। গোত্রপতি যাঁরা আছে তাঁরে স্মরিয়ে। গায়ত্রী জপিলে জট যাবে যে খুলিয়ে। বস্মিত হয়ে তারা সকলে দেখল। আপনা আপনি জট খুলিয়া যে গেল। সকলে ধরিল লোকনাথের চরণ। বলে বাবা ক্ষমা কর মোরা অভাজন। এ কথা লোকমুখে প্রচার হল। বাবার দর্শনে বহু নর-নারী এলো। সকলে বুঝল বাবা সামান্য তো নয়। বাবার চরণে সবে লভিল আশ্রয়। মহাপ্রয়াণ সেদিন উনিশে জৈষ্ঠ আর রবিবার। সকালে হয়েছে খোলা মন্দিরের দ্বার। রামকুমার, চন্দ্র ভট্টাচার্য দু’জনে। বাবার মন্দিরে আসি প্রণমে চরণে। মন্দির মাঝারে বাবা ছিলেন বসিয়ে। চরণে প্রণাম করে দুই শিষ্য গিয়ে। চন্দ্র ভট্টাচার্যে বাবা বলেন ইঙ্গিতে। কিছুক্ষণ গিয়ে তুমি বস বাহিরেতে। চন্দ্রকান্ত গিয়ে তবে বাবার আদেশে। মন্দির হতে গিয়ে বাহিরেতে বসে। মন্দিরেতে রামকুমার গুরুদেব সনে। নানা কথা আলোচনা করেন গোপনে। চন্দ্র ভট্টাচার্য থাকে বসিয়ে বাহিরে। গুরুর আদেশে অতি ধৈর্য সহকারে। রামকুমার সহ বাবা নানা কথা কয়। বাহির হতে কিছু নাহি জানা যায়। বাবা বলে শুন ভক্ত তোমারেই জানাই। শুভলগ্ন সমাগ বিলম্ব যে নাই। আজই পূর্বাহ্নে আমি ত্যাজিব শরীর। ধর্মপথে সর্বক্ষণ রইবে সুস্থির। এ দেহ ত্যাগ আমি অবশ্য করব। কিন্তু তোমাদের আমি ছাড়িয়ে না যাব। সুঃদেহ এর পর করিয়া ধারণ। ভক্তের উপরে সদা সু-দৃষ্টি রবে। স্বরণ করিও মনে মনে একবার। আসব তখনি আমি করি অঙ্গীকার। রণে বনে যেস্থানে থাকবে যখন। একবার মনে মনে করিও স্বরণ। জয় বাবা লোকনাথ পতিত পাবন। রক্ষা করো বিপদেতে বিপদ বারণ। মন্ত্র নাহি জানি অধম সন্তান। সঙ্কটে পড়লে বাবা করো মোরে ত্রাণ। বাবার পাঁচালী হেথা হল সমাপন। জয়বাবা লোকনাথ বল ভক্তগণ। ![]() |