যুগাবতার বাবা লোকনাথ সুখময় চক্রবর্ত্তী
যিনি অব্যক্ত, নির্বিশেষ, নির্বিকার, লীলাবশে তিনিই ব্যক্ত হয়ে সবিশেষ রূপ ধারণ করেন-ইহাই অবতার। সনাতন ধর্মের সারাৎসার শ্রীমদ্ভগব˜্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৭ম ও ৮ম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতার সম্পর্কে বলেছেন- “যদা যদা হি ধর্মস্য গøার্নিভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজাম্যহম্”(৭) হে ভারত(অর্জুন), যখনই যখনই ধর্মের গøানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয় আমি সেসময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণ পূর্বক অবতীর্ণ হই)।
“পরিত্রাণানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে”\ (৮) সাধুগণের পরিত্রাণ দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। “সম্ভবামি যুগে যুগে” অর্থাৎ প্রয়োজন হলে ভগবান প্রত্যেক যুগে অবতার রূপে আসেন। এক যুগের মধ্যেও যতবার প্রয়োজন হয় ততবার ভগবান অবতার রূপ ধারণ করেন। কারকপরুষ (যে মহাপুরুষ ভগবানকে প্রাপ্তি করেছেন এবং ভগবৎ ধামে অবস্থান করেন তাঁকে কারকপুরুষ বলা হয়) এবং সাধু মহাত্মারূপেও ভগবান অবতীর্ণ হন। ভগবান এবং কারকপুরুষের অবতার হচ্ছে “ নৈমিত্তিক” কিন্ত সাধু মহাত্মাদের অবতার হচ্ছে ‘নিত্য’।
লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতারের উদ্দেশ্য তিনিটি (১) দুষ্কৃতদিগের বিনাশ, (২) সাধুদিগের পরিত্রাণ এবং (৩) ধর্ম সংস্থাপন। ভাগবতে দ্বাবিংশ অবতারের উল্লেখ আছে এবং এ প্রসিদ্ধ শ্লোকাংশ আছে- “এতে চাংশ কলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্ত ভগবান স্বয়ং।” অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, পরব্রহ্ম, সমস্ত অবতার তাঁরই অংশ ও কলা।
পৌরাণিক নৃসিংহাদি অবতারের অসুর বিনাশ ব্যতীত আর বেশি কিছু প্রয়োজন দেখা যায় না। কিন্তু বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি অবতারে অসুর বিনাশ নেই। এ সকল অবতারের একমাত্র উদ্দেশ্য মানবাত্মাকে দিব্য প্রেম- ভক্তি- পবিত্রতা- জ্ঞান- শক্তির অনুপ্রেরণা দেয়া।
প্রশ্ন উঠতে পারে ভগবান তো সর্বসমর্থ, সাধুদের রক্ষা, দুষ্টের বিনাশ, ধর্মের স্থাপনা এসব কাজ তিনি অবতার না হয়ে করতে পারেন না ? ভগবান অবতার না হয়েও অনায়াসে সবকিছু করতে পারেন এবং করেনও। তবুও জীবের উপর বিশেষভাবে কৃপা করে, জীবের দুঃখ দুর্দশা দেখে তাদের মঙ্গল করার জন্য ভগবান স্বয়ং অবতীর্ণ হন। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে-“অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাস্থিতঃ। ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়া যা শ্রæত্বা তৎপরো ভবেৎ” \ অর্থাৎ ভগবান জীবকে বিশেষ কৃপা করার জন্যই নিজেকে মনুষ্যরূপে প্রকটিত করেন এবং এমন লীলা করেন যে, যা শুনে জীব ভগবৎপরায়ণ হয়।
কারকপুরুষ এবং সাধুমহাত্মাদের যে অবতারের কথা উপরে বলা হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় কলিযুগের এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমীতে, একই নক্ষত্রে (রোহিনী নক্ষত্রে) ধরাধামে অবতীর্ণ হন কলিরত্রাতা, জগদ্গুরু, ঈশ্বরকোটির মহাপুরুষ, পরমপুরুষ, পূর্ণব্রহ্ম যুগাবতার ভগবান শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা।
ত্রিকালজ্ঞ মহাযোগী জাতিস্মর মহাপুরুষ শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার আবির্ভাব বড়ই চমৎকার। প্রায় তিনশত বছর আগের কথা। ভারতবর্ষ তখন নানা প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, অনাচার, নারী নির্যাতন ইত্যাদিতে ভরপুর। ছোট্ট একটি জনপদ, নাম বেরুগ্রাম। গ্রামটি বর্ধমান জেলায় অবস্থিত। গ্রামের নিকটেই দামোদর নদী প্রবাহিত। গ্রামটি ছোট্ট, গ্রামের লোকদের অবস্থা মধ্যবিত্ত, গরীব। নানাজাতের লোক নিয়েই ছিল গ্রামটি। সেখানে এক বন্দ্যোপাধ্যায় বংশে শুভ মুহূর্তে ভূমিষ্ট হল এক শিশু। যথা নিয়মে শিশুর নাম রাখা হল সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সীতানাথের একটু বয়ক্রম হবার পরই চলাফেরা, কথাবার্তা, শিক্ষাদীক্ষা সব কিছুতেই যেন এক বিষাদ যোগের পূর্ণ লক্ষণ ফুটে উঠেল। সীতানাথ দামোদর নদের তটে বসে সব সময় ভাবত কেমন করে এ জগত থেকে জীবের দুঃখ দুর্দশা দূর করে জীবকে উদ্ধারের পথ দেখানো যায়। এমনিভাবে ভাবতে ভাবতে সীতানাথের জীবন অবসানের সময় উপস্থিত। এ দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার বারাসাতের অন্তর্গত চৌরাশী চাকলা মতান্তরে কচুয়া গ্রামে বাস করতেন রামকানাই ঘোষাল ও কমলাদেবী নামে দেব দ্বিজে ভক্তিপরায়ণ এবং অত্যন্ত ধার্মিক দম্পতি। তাঁদের মনে একটা বড় বাসনা এমন একটি সন্তান তাঁদের বংশে জন্ম হোক যে এ জগতের সমস্ত জীব উদ্ধার করবে। একদিকে সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জগত থেকে দুঃখ দুর্দশা দূর করে জীব উদ্ধারে চিন্তা
অন্যদিকে রামকানাই ও কমলা দেবীর মনের বাসনা উভয়ের প্রতিফলন স্বরূপই সে শুভলগ্নে বাংলা ১১৩৭ বঙ্গাব্দ ১৮ই ভাদ্র মঙ্গলবার ইংরেজি ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মাষ্টমীর মহালগ্নে আবির্ভূত হন দ্বাপর যুগে যিনি এক অজন্মা এসেছিলেন দেবকীর গর্ভে সে এক পূর্ণ পুরুষ মায়ার শরীর ধারণ করে এলেন জননী কমলার কোল আলো করে। এক দিব্যজ্যোতিতে জননীর মুখমÐল আজ উদ্ভাসিত। কোলে সন্তান যেন সাক্ষাৎ গোপাল, অপরূপ, দেহকান্তি অতুলনীয় মাধুর্যমÐিত, চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেই আজ কেমন বিস্ময় এবং ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে যান। বুঝতে অসুবিধে হয় না এ অলৌকিক দেব দুর্লভ দৃষ্টিসম্পন্ন শিশু সন্তানের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য।
সন্তানের জন্মের সাথে সাথেই পিতা রামকানাই ঘোষাল শরণাপন্ন হন তৎকালীন ভারতবর্ষের অদ্বিতীয় পÐিতপ্রবর ভগবান গাঙ্গুলীর এবং নবজাতকের আচার্য গুরুরূপে পবিত্র উপনয়ন সংস্কারসহ অধ্যাত্ম জীবনের গুরুভার গ্রহণ করার জন্য সবিনয় নিবেদন জানান। সানন্দে ভগবান গাঙ্গুলী স্বীকৃতি দান করে বলেন- “ রামকানাই তুমি পরম ভাগ্যবান, তাই এমন সন্তানের পিতা হবার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেছ। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, ঐ ঈশ্বর প্রেরিত শিশু সন্তান কেবল তোমার ক্ষুদ্র কুল উদ্ধার করার জন্যই জন্মগ্রহণ করেনি বরং এর মধ্যে লুকিয়ে আছে জগত উদ্ধারের মহাবীজ। কালে এ সন্তানই অগণিত পাপতাপক্লিষ্ট লোকের নাথ হয়ে জগতগুরুর আসন অধিকার করবে, তাই এ সন্তানের নামকরণ করলাম লোকনাথ অর্থাৎ লোকের নাথ।”
যথাকালে আচার্যগুরু ভগবান গাঙ্গুলীর নিকট উপনয়ন সংস্কার পূর্বক দীক্ষা নিয়ে উপনয়ন গৃহ থেকেই সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করেন এবং আজীবন ব্রহ্মচর্যের দ্বারা সনাতন ধর্মের সর্বোচ্চ কৃচ্ছ সাধনার মাধ্যমে অষ্টাঙ্গিক যোগের কঠিনতম যোগসাধনার সব কটি সোপান পেরিয়ে সাধনার সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ পূর্বক প্রায় শতবর্ষে অর্থাৎ ৯০ বছর বয়সে কঠিনতম তপস্যার ফল স্বরূপ পূর্ণযোগের পূণ্য ভূমিতে (হিমালয়ে) পূর্ণব্রহ্মস্বরূপ হয়ে লাভ করলেন পরমসিদ্ধি। মÐক উপনিষদের ভাষায়-“ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি।” অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে লাভ করেন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান। পরমসিদ্ধি লাভের পর বাবা লোকনাথ বললেন “সমাধির উচ্চতম শিখরে বহুদিন অবস্থান করার পর পৌঁছালাম সে পরমতত্তে¡, যেখানে আমি ও সমগ্র অখিল ব্রহ্মাÐের অস্তিত্বের মধ্যে নেই কোন ভেদ, মিলে মিশে একাকার।”
আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাও। সনাতন ধর্মের এ সত্য ধারণ করে সর্বশাস্ত্র সারভূতা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটিয়ে নিজে গীতা হয়ে গীতার সুরকে আরও সহজ করে জোরালো কন্ঠে বলেছিলেন-“গীতায় বর্ণিত সেই পরমাত্মা আমিই”। আমার বিনাশ নেই, শ্রাদ্ধ নেই, আমি নিত্য পদার্থ, আমি অবিনশ্বর। অর্থাৎ ‘অস্ত্র যাকে ছেদন করতে পারে না, অগ্নি যাকে প্রজ্জ্বলিত করতে পারে না, বরুণ যাকে আদ্র করতে পারে না, বায়ু যাকে শুষ্ক করতে বিফলকাম হয় সেই পরমাত্মা আমিই।’ আমি ব্রহ্ম। সমস্ত দেব-দেবতা আমার অঙ্গের বিভূতি মাত্র। নিজে গীতা হয়েছেন বলেই তাঁকে বলা হয়ে থাকে জীবন্তগীতা বা চলন্তগীতা বা মূর্তগীতা। জীবন্তগীতা লোকনাথ বলেছেন-“ওরে গীতা কি পাঠ্য পুস্তক যে কন্ঠস্থ করবি, সব সংস্কৃত শ্লোক। গীতা হচ্ছে গীত। প্রতিটি ভক্তের হৃদয়ে ভগবান নিত্য গীতা শুনাচ্ছেন, যে দিন শুনতে পাবি সেদিন গীতা হয়ে যাবি। গীতা হবার সাধনা কর”।
বাবা লোকনাথের প্রতিটি বাণীর মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই শ্রীকৃষ্ণকে। সেই পূর্ণপুরুষ যেন আবার কায়া গ্রহণ করেছেন। আবার বলেছেন গীতার জ্ঞান। গীতার সপ্তম অধ্যায়ের ২৪ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- “অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ। পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ \” অল্প বুদ্ধি ব্যক্তিগণ আমার সর্বোৎকৃষ্ট পরমভাব না জেনে অব্যক্ত আমাকে সচ্চিদানন্দময় পরমাত্মাকে মানুষের ন্যায় শরীর ধারণকারী বলে মনে করে থাকে। গীতার নবম অধ্যায়ের ১১ নং শ্লোকে ভগবান বলেছেন- “অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ । পরং ভাবমজানন্তো মম ভূত মহেশ্বরম্ \” অজ্ঞানান্ধ মূঢ় চিত্ত মানুষ সর্ব প্রাণীর মহেশ্বর স্বরূপ আমার পরমভাব না জেনে আমাকে মানুষ দেহধারী সাধারণ জীব বলে অবজ্ঞা করে। জীবন্তগীতা লোকনাথ বলেছেন- “ ওরে তোরা আমাকে কেবল শরীর (মানুষ) ভেবে ভেবেই সব মাটি করলি। ” গীতায় ভগবার শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- “ ন মে ভক্ত প্রণশ্যতি।” আমার ভক্তের বিনাশ নেই। জীবন্তগীতা লোকনাথ আরো জোরালো কন্ঠে বলেছেন- “ যে আমার আশ্রিত তার ক্ষতি সাধন করে কার বাপের সাধ্য ? এমন শক্তি পৃথিবীতে কারুর নেই।” গীতায় ভগবান বলেছেন- “ যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্\” অর্থাৎ- যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে আমি তাকে সেভাবেই তুষ্ট করি। আর মূর্তগীতা লোকনাথ আরও জোর দিয়ে বলেছেন-“যে যখন যেভাবে বিপদে আপদে আমায় স্মরণ করবে সেক্ষণেই আমার কৃপা লাভ করবে।”। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-“সর্বধর্মান্ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচ \”১৮/৬৬ । সব কিছু পরিত্যাগ করে তুমি শুধু আমাকে স্মরণ কর। আমি তোমাকে মুক্ত করব। অর্থাৎ ত্যাগের কথা নিষ্কাম কর্মের কথা বলেছেন। কিন্তু কলিজীবের পক্ষে নিষ্কামকর্মী হওয়া খুবই কঠিন। তাই কলির এ ক্রান্তিলগ্নে এসে চলন্তগীতা মানবত্রাতা লোকনাথ
গীতার সুরকে আরও সহজ করে বলেছেন- “ ভক্তের বোঝা আমি নিজ স্কন্ধে বয়ে বেড়াই। তোদের সব দায়িত্ব আমার, শুধু তোদের সহজ সরল মনটুকু আমায় দে। আমি যে তোদের প্রেমের কাঙাল। শতাধিক বছর পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে আমি বড় একটা ধন কামাই করেছি কত বরফ এ শরীরের উপর দিয়ে জল হয়ে গেছে। তোরা এখন কেবল ঘরে বসে খাবি। তোদের ঐ বাবা ডাকটুকু শুনার জন্যই আমি এত সাধানা করেছি। যে তার মনপ্রাণ আমায় দিতে পেরেছে আমি তারই হয়ে গেছি, তার কাছে আমি ঋণী”। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ দেখিয়ে ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সখা অর্জুনকে। আর যুগাবতার বাবা লোকনাথ পূর্ণস্বরূপ ধরা দিয়েছিলেন তাঁর সব থেকে প্রিয়জন যাঁকে তিনি জীবনকৃষ্ণ প্রাণকৃষ্ণ বলে ডাকতেন সেই প্রিয় ভক্ত বৈষ্ণবকুল চূড়ামণি প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর কাছে। যিনি বাবার স্বরূপ দেখে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ঢলে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন বাবা তাঁকে আলিঙ্গন করে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন কিরে বিজয় এখনও পাকা হসনি বুঝি। বিজয়কৃষ্ণজী জ্ঞান ফিরে পেয়ে বলেছিলেন-“আমি এ কি দেখলাম! যাঁর প্রতিটি লোককূপে দেবদেবী, গাত্রবস্ত্রে দেবদেবী, গৃহের সর্বত্র দেবদেবীময়। তাঁকে আমি ত্রিসন্ধ্যায় ত্রিবিধ মূর্তিতে ধ্যান করতে দেখেছি। আমি অনেক পাহাড় পর্বত পরিভ্রমণ করেছি, অনেক সাধু মহাপুরুষের সঙ্গ লাভ করেছি। এমন মহাশক্তিধর সিদ্ধ মহাপুরুষ আমি কোথাও দেখিনি। তিনি পূর্ণপুরুষ। আমি বহু মঠ মন্দিরে গিয়েছি কোথাও দু’আনা পেয়েছি, কোথাও চারআনা পেয়েছি, কোথাও বা আট আনা পেয়েছি। একমাত্র বারদীধামে এসে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মধ্যেই ষোল আনা পেলাম”।
বাবা লোকনাথ ছিলেন ভাবাতীত, গুণাতীত এবং বাক্যাতীত পুরুষ। তিনি ছিলেন নিত্য লীলাময় পুরুষ। তাঁর অপরূপ লীলাবিভূতি বর্ণনাতীত। বারদী ধামে অবস্থানকালে তিনি যে কত লীলা করে গেছেন এবং আজও সূ² দেহে নিত্যলীলা করে যাচ্ছেন তা বর্ণনা করে প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না। সারা বিশ্ব ব্রহ্মাÐ পরিভ্রমণ শেষে তাঁর লীলাধাম মহাপীঠ বারদীতে ২৬ বছর লীলা করে মহাপ্রয়াণে গমনের সময় বলেছিলেন- “ আমি বারদীতে এসে একটি ফুলের বাগান তৈরি করে গেলাম। সময়ে এ বাগানে ফুল ফুটবে, তার সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে, জগৎ আমোদিত হবে, একশত বছর পর আমি আবার আসব সকলের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাব। আজ সে ক্রান্তিকাল অতিবাহিত হচ্ছে। বাবা লোকনাথের তিরোধানের পর ১২২ বছর চলছে। বিগত ১২২ বছর ধরেই বাবা লোকনাথের প্রতিশ্রæত সত্যবাণী মহাসত্যরূপে কলির যুগক্ষণে সর্বাংশে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাঁর প্রতিশ্রæতি রক্ষা করতে আজ তিনি সূ² দেহে সারা বিশ্বের প্রতি ঘরে ঘরে পৌছে গেছেন। আজ তাঁর অপূর্ব লীলা মহাত্ম্য প্রচারিত হচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র।
বাবা লোকনাথ মহাপুরুষ নন। সনাতন ধর্মের সকল দিক বিচার বিশ্নেষণ করলে দেখা যায় পরমপুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন অষ্টাদশ পুরাণে, অষ্টাদশ স্মৃতিতে, বেদ চতুষ্টয়ে এবং সর্বোপনিষদের প্রাণপুরুষ। তিনি বেদান্তের ব্রাহ্মণ, পাতঞ্জলের ঈশ্বর, সাংখ্যের পুরুষ, গীতার মূলবস্তু ভক্তের সাক্ষাৎ ভগবান। ভগবান কি ? ভগ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঐশ্বর্য বা গুণ আর বান শব্দের অর্থ হচ্ছে যুক্ত হওয়া। অর্থাৎ যাঁর মধ্যে কতগুলো বিশেষ ঐশ্বর্য বা গুণ যুক্ত আছে তিনিই ভগবান।“ঐশ্বর্য্যস্য সমগ্রস্য বীর্যেস্য যশসঃ শ্রীয়। জ্ঞান বৈরাগ্যয়োশ্চৈব বন্নং ভগ ইতি স্মৃতম্\” যাতে সমস্ত ঐশ্বর্য, বীর্য, যশঃ, শ্রীঃ জ্ঞান ও বৈরাগ্য- ্এ ছয়টি গুণ একাধারে বিদ্যমান তিনিই ভগবান। বাবা লোকনাথের মধ্যে এ সকল গুণ পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান তাইতো তিনি ভক্তের কাছে পূর্ণব্রহ্ম ষড়ৈশ্বর্যময় ভগবান। মানুষের শরীর ধারণ করে নিয়েছিলেন কেবল জগৎকে বোঝানোর জন্য যে বেদবেদান্ত উপনিষদে যা আছে তা কেবল গল্প নয় তা সনাতন সত্য। তিনি সর্বদেবদেবীময়। তিনিই পূর্ণব্রহ্ম। তিনিই সব হয়েছেন। যার উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- তিনি গোয়ালিনী মাকে কালীঘাটের কালী রূপে দর্শন দিয়েছিলেন। আর এক ভক্তকে পুরীর জগন্নাথ রূপে দর্শন দিয়েছিলেন।
বাবা লোকনাথ বলেছেন- “আমি সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করেছি তোদের ভগবানের সাথে আমার দেখা হয়নি, আমি দেখেছি আমাকে।” ইহাই আত্মদর্শন, ইহাই সনাতন ধর্মের সারকথা।“আত্মানং বিদ্ধি”-নিজেকে জানা (কহড়ঞিযুংবষভ) আত্মোপলব্ধির মাধ্যমেই বাবা হয়েছিলেন সচ্চিদানন্দ পূর্ণব্রহ্ম ষড়ৈশ্বর্যময় ভগবান। সনাতন ধর্মের সর্বোচ্চ আদর্শ- ঈশ্বর হয়ে ঈশ্বর দর্শনের চরম উপলদ্ধির উপরই প্রতিষ্ঠিত। সেহেতু তিনি বলতে পেরেছিলেন- “রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও- আমিই রক্ষা করিব।” পরিশেষে বলা যায়-“ সত্যযুগে সত্য নারায়ণের সেবা করে মানুষ যা পেয়েছে, ক্রেতা যুগে রামচন্দ্রের ভজনা করে মানুষ যা পেয়েছে, দ্বাপরযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করে মানুষ যা পেয়েছে,কলিযুগে কলিরত্রাতা যুগাবতার শ্রীশ্রী বাবা লোকনাথের শুধুমাত্র নাম স্মরণ করেই মানুষ তা অনায়াসে পেতে পারে।”
ওঁ প্রণমামী অহেতুক কৃপাসিন্ধুং সদগুরুং শ্রী লোকনাথং।
ভবভয় হরং অবতার বরিষ্টং শ্রীলোকনাথং,
শ্রীলোকনাথং, শ্রীশ্রীলোকনাথং \
প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, শ্রীশ্রী লোকনাথ স্মৃতিতর্পনসংঘ মহেশাঙ্গন, কুমিল্লা, বাংলাদেশ।